
এত সেঞ্চুরি করেও জাতীয় দলে কেন উপেক্ষিত বিজয়
ইকবাল আজাদ
২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:৫৩
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো আসর মানেই যেন এনামুল হক বিজয়ের ব্যাটে রানের ফোয়ারা। সাদা কিংবা রঙিন পোশাক অথবা ফরম্যাটের ভিন্নতা—সবখানেই বিজয়ের জয়জয়কার। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২১ হাজার ২২৫ রান করেছেন বিজয়। যার ৯১ শতাংশই করেছেন ঘরোয়া লিগের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) গতকাল ব্যাট হাতে ইতিহাস গড়েছেন এই ব্যাটার। দেশের প্রথম ব্যাটার হিসেবে স্বীকৃত ক্রিকেটে সেঞ্চুরির ‘ফিফটি’ হাঁকিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ এনামুল হক বিজয় এখন ৫০টি সেঞ্চুরির মালিক। ইতিহাস গড়া এই ব্যাটার তবুও জাতীয় দলের আশেপাশেও নেই। কিন্তু কেন? জানতে হলে একটু পেছনে ফিরতে হবে।
ঘরোয়া লিগে দীর্ঘদিন ধরে বিজয়ের ব্যাটে রানবন্যা দেখছেন দর্শকেরা। তবুও তাকে জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া নিয়ে নির্বাচকদের নীরব আপত্তি। কারণ হিসেবে তাদের নিয়মিত মন্তব্য, বিজয়ের চেয়ে ভালো ব্যাটার দলে আছেন। সেঞ্চুরির কথাই ধরা যাক। ৫০ সেঞ্চুরির ৪৭টাই করেছেন ঘরোয়া লিগে। জাতীয় দলের জার্সিতে সবশেষ শতক এসেছে ২০১৪ সালে।
এদিকে ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স বিবেচনায় বিজয়কে সুযোগ দিলেও হয়েছে উল্টো ঘটনা। স্থানীয় টুর্নামেন্ট কাঁপিয়ে এসে জাতীয় দলের জার্সিতে ব্যাট হাতে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। পরিণামে দল থেকে বাদ পড়েছেন এনামুল হক। ডানহাতি এ ক্রিকেটারের জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ঘাঁটলে এমন চিত্রই ফুটে ওঠে।
পরিসংখ্যানে চোখ বুলানো যাক। টেস্টে এখন পর্যন্ত ১০ ইনিংস সুযোগ পেয়েছেন বিজয়। যেখানে এই ওপেনার মাত্র ১০ গড়ে ১০০ রান করেছেন। অথচ ঘরোয়া লিগে দীর্ঘ সংস্করণের ক্রিকেটে তার শতকের সংখ্যা ২৪টি। ওয়ানডেতেও একই অবস্থা। লিস্ট এ ক্রিকেটে তার শতকের সংখ্যা ২৩টি। যেখানে মাত্র ৩টি শতক জাতীয় দলের জার্সিতে।
২০১৪ সালে ওয়ানডেতে সবশেষ শতকের দেখা পেয়েছেন তিনি। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেললেও কোনো সেঞ্চুরি করতে পারেননি এই ওপেনার। উল্টো সেঞ্চুরির পর হওয়া তার ব্যাটিং গড় ৩৮ থেকে কমে ২৯-এ নেমেছে। ওয়ানডেতে সবশেষ ২৮ ম্যাচে ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ২৩!
ঘরোয়া লিগে রানের বন্যা বইয়ে ২০২৩ সালে ৪টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন বিজয়, করেছেন মাত্র ৮৬ রান। ২০২৪ সালে এক ম্যাচে মাত্র ১২ রান করে দৃষ্টিকটু আউটে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।
ওয়ানডেতে ৪৬ ইনিংস ব্যাট করেছেন বিজয়। এর মধ্যে সব ইনিংসেই আউট হয়েছেন তিনি। তাতে ৭০ শতাংশই ছিলো ক্যাচ আউট। অর্থাৎ উইকেটের পেছনে খোঁচা, ব্যাটে বলে ঠিকমতো সংযোগ করতে না পারায় আউট হয়েছেন এই ক্রিকেটার।
টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে ঘরোয়া লিগের অন্যন্য নাম এনামুল হক। বিপিএল কিংবা অন্যান্য টুর্নামেন্টের রান সংগ্রাহকের তালিকায় সেরা পাঁচে থাকে বিজয়ের নাম। কিন্তু জাতীয় দলে ফেরালেই তার রান করা যেন হঠাৎই উবে যায়। বুদ্ধিহীন শট আর ডট বলের প্রবণতা কুড়ি ওভারের ক্যারিয়ারটা আর সমৃদ্ধ করতে পারেননি।
লাল-সবুজের জার্সিতে ২০২২ সালে সবশেষ খেলা ৭টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১২ গড়ে করেছেন মাত্র ৯০ রান, স্ট্রাইক রেট ৯৫! টি-টোয়েন্টি ম্যাচে একজন ওপেনারই যখন ১০০-এর কম স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেন, তখন দলের নাজুক অবস্থা অনুমিত। অথচ গেল বিপিএলেও বিজয় ছিলেন রাজশাহীর ভরসার প্রতীক। এমনকি বিগত আসরগুলোতেও রানে সেরা তালিকায় ছিলেন তিনি।
ঘরোয়াতে এত রান করেন কীভাবে
দেশের ঘরোয়া লিগে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের কমই দেখা যায়। খুব একটা অবসর না থাকলে তো দেখাই যায় না। এ তালিকায় ভালো বোলারদের সংখ্যা আরও কম। ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট আর ইনজুরির ধকল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ঘরোয়া লিগে জাতীয় দলের বোলাররা কমই খেলে থাকেন। এখানেই সুযোগ লুফে নেন এনামুল হক বিজয়।
অল্প অভিজ্ঞ বোলার আর মানহীন বোলিংয়ের সামনে ব্যাটকে তরবারি বানান তিনি। আবার ঘরোয়াতে বিপক্ষ দলের ব্যাটারদের নিয়ে হয় না কোনো বিশ্লেষণ। ফলে তেমন কাটাছেঁড়া ছাড়াই নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন বোলাররা। এতেই বিজয়, তুষার ইমরানদের রান আর রেকর্ডের সংখ্যা বাড়তেই থাকে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো মানের বোলারদের সামনে এনামুলকে বেশ সংগ্রাম করতে দেখা যায়। এমনকি বিপিএলে নামকরা বিদেশি বোলারদের কাছে বিপাকে পড়েন এই ব্যাটার।
জাতীয় দলে বিজয় যেভাবে পিছিয়ে
টপ-অর্ডার ব্যাটার হিসেবে জাতীয় দলে খেলে থাকেন বিজয়। বর্তমানে একই পজিশনে খেলছেন এমন সব ব্যাটার থেকে পরিসংখ্যানে বিজয় বেশ পিছিয়ে। সেদিক থেকে নির্বাচকদের রাডারে নেই এই ক্রিকেটার। ঘরোয়া লিগের রান দেখে অতীতে বিজয়কে একাধিকবার জাতীয় দলে নেওয়া হলেও তিনি তার দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেননি। বরং বাজে শট খেলে দলকে বিপদে ফেলে ফিরেছেন।
বিশ্লেষকদের ভাষায়, বিজয়ের শট খেলার দক্ষতা তুলনামূলক কমই বলা চলে। লিটন-তামিমদের মতো অনায়াসে সব শট খেলতে পারেন না তিনি। আবার পায়ের ব্যবহার নিয়েও ক্রিকেটীয় ব্যাকরণও মানেন না এই ক্রিকেটার। ফলে অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়েই সবচেয়ে বিপাকে পড়েন বিজয়। পায়ের ব্যবহার না থাকায় ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে বহুবার উইকেট বিলিয়েছেন তিনি।
ওয়ানডেতে ৪৬ ইনিংস ব্যাট করেছেন বিজয়। এর মধ্যে সব ইনিংসেই আউট হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই কট আউট। অর্থাৎ উইকেটের পেছনে খোঁচা, ব্যাটে বলে ঠিকমতো সংযোগ করতে না পারায় আউট হয়েছেন এই ক্রিকেটার। টেস্টে ক্যাচ আউটের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ এবং টি-টোয়েন্টিতে ক্যাচ দিয়ে ৬০ শতাংশ বার আউট হয়েছেন এই ক্রিকেটার।
পাশাপাশি নির্দিষ্ট স্কোরিং জোন (কাভার, পয়েন্ট, মিড উইকেট) বন্ধ করে দিলে রানের পরিবর্তে ডট বলের মিছিলে যোগ দেন বিজয়। সবমিলিয়ে ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রাখতে পারায় জাতীয় দলের বিবেচনায় থাকেন না এই ক্রিকেটার।
এমআই