
‘পাশের বাসার আন্টি’-কে সমালোচনার সুযোগ করে দিলো রাজশাহী
খেলা ডেস্ক
২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৩২
পরীক্ষার খাতায় একশতে একশো কয়জন পায়, এই হাতেগোনা দুয়েক জন। কিংবা ক্লাসে রোল ১ কয়জনের হতে পারে, নিশ্চয়ই একজনের। শ্রেণিকক্ষে কিংবা কোনো প্রতিযোগিতায়, নিজের বাচ্চাকে সেরাদের সেরা হিসেবে দেখতে চায় প্রত্যেক অভিভাবক। কিন্তু ওই জায়গা যে শুধু একজনের জন্য, কিছু অভিভাবক সেটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না। এর ফলে সবচেয়ে বেশি আপদ জুটে সন্তানের কপালে।
আপদের পাল্লাটা আরও ভারী করেন পাশের বাসার আন্টি। অন্যের বাচ্চা এ জীবনে কী কী সাফল্য পেল, তা আপদে পড়া বাচ্চার মা’কে শুনিয়ে আক্ষেপ-আফসোসের বিরহটা আরও তাতিয়ে তুলেন তিনি। এমনকি বিরহের গল্পটা আরও রসালো করতে সাফল্য পাওয়া ছেলেটার আর্থিক সংকট, সীমাবদ্ধতা এবং নানান ‘না’ পাওয়ার ঘটনা জুড়ে দেন ‘পাশের বাসার আন্টি’ নামক চরিত্র। এতেই মরার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়ে মধ্যমমানের শিক্ষার্থীদের ওপর।
মধ্যমমানের শিক্ষার্থী কেমন, এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো সবারই জানা। তবুও বলছি, একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পূর্ণ নাম্বার পাবেন না আবার অকৃতকার্যও হবেন না; কিন্তু মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে পাস করবেন, তারাই মূলত মধ্যমমানের শিক্ষার্থী। পাশের বাসার আন্টি চরিত্র এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর যেন একটু বেশিই ঝুঁকেন। কারণ নিম্নগামী শিক্ষার্থীদের মায়ের কানভারী করে তেমন কোনো পাত্তা পাওয়া যায় না। কিন্তু মধ্যম লেভেলে সবসময় একটা হাহাকার প্রক্রিয়া থেকেই যায়।
বিপিএলের একাদশ আসরে পাশের বাসার আন্টিদের সমালোচনার জন্য দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে দুর্বার রাজশাহী। পেমেন্ট ইস্যুতে বিতর্কিত এই দলকে সাফল্যের সূতিকাগার ধরে বাকি দলগুলোর সমালোচনায় মাততে পারবে যে কেউই। আর ‘পাশের বাসার আন্টি’ থিওরি অনুসরণ করলে ব্যাপারটা আরও সহজ। অর্থ সংকট, আগামী দিনের অনিশ্চয়তা, লজ্জার বিতর্ক আর ক্রীড়াঙ্গনে বেশ সমালোচনা জন্ম দেওয়ার পরেও বাইশ গজে বেশ মনোযোগী ছিল রাজশাহীর ক্রিকেটাররা।
পেমেন্ট না পাওয়ায় চট্টগ্রাম পর্বে হুট করে অনুশীলন বয়কট করে এনামুল হক বিজয়ের দল। এমনকি টাকা না পেলে পরবর্তী ম্যাচ খেলতে মাঠে নামবে না বলেও হুমকি দিয়েছিল তাঁরা। যদিও এর মাঝে ত্রাতা হয়ে এসেছিল স্বয়ং বিসিবি। পরবর্তীতে উভয়পক্ষের সমোঝোতায় মাঠে নেমেছিল রাজশাহী ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম। এত নাটকীয়তার পরের ম্যাচেই সিলেটের বিপক্ষে জয় তুলেছিল তাঁরা। এমনকি টুর্নামেন্টের পরের ম্যাচে খুলনার ২১০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে খুব কাছে গিয়ে হেরেছিল বিজয়ের দল। এরপর চিটাগং এর বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে নাটকীয় অধিনায়ক বদল।
নতুন অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামা তাসকিন প্রথম ম্যাচটা বাজে ভাবে হেরেছিলেন। তাতেই দুর্বল রাজশাহীর টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ার প্রহর গুনেছিল ভক্ত-সমর্থকরা। এমন আশঙ্কার কারণ, রাজশাহীর শেষ তিন ম্যাচের দুটো আবার রংপুর রাইডার্সের সাথে। যারা চলতি আসরে টানা ৮ ম্যাচ অপরাজিত ছিল। সেই রংপুর চট্টগ্রাম পর্বের শেষ দিনে রাজশাহীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাসকিনদের এমন জয়কে ‘পচা শামুকে পা কাটা’ বলে সম্বোধন করেছিল রাইডার্সদের সোশ্যাল মিডিয়া টিম। কিন্তু সেই শামুক ঢাকায় এসেই আবার রংপুরকে পরাজয়ের বৃত্তে ঘিরে ফেলেছে।
ঢাকা পর্বে এমন দিনে তাসকিনেরা জয় পেলেন, যেখানে ম্যাচ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে মালিকদের অর্থ সংকটে হোটেল বদল করতে হয়েছিল। এমনকি টাকা না পাওয়ায় রংপুরের বিপক্ষে খেলতে মাঠে যায়নি রাজশাহীর কোনো বিদেশি ক্রিকেটার। বিপিএলে লজ্জার ইতিহাস গড়ার দিনেই রংপুরকে হারিয়েছিল দুর্বার রাজশাহীর দেশি ক্রিকেটাররা। টেবিল টপারদের টানা দুই ম্যাচ হারানোর পরে সিলেটের বিপক্ষে আত্মবিশ্বাসটা পুঁজি করে নেমেছিল তাসকিনের দল। সেটার প্রতিফলনও দেখা গেল মাঠে। বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন রাজশাহীর বোলাররা। ব্যাট হাতে শুরুতে ৪ উইকেট হারালেও আগের ম্যাচের আত্মবিশ্বাসের কারণে এবার সিলেটকেও হারিয়েছে টিম রাজশাহী।
দলের নাম এবং মানের বিচারে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই পিছিয়ে ছিল দুর্বার রাজশাহী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘দুর্বল রাজশাহী’ হিসেবেও ট্রলের শিকার হতে হয়েছে তাদের। এমনকি বিপিএলের শুরুর ম্যাচগুলো দেখে রাজশাহীকে টেবিলের তলানিতে রেখে হিসাব কষেছিল বিশ্লেষকেরা। কিন্তু সেই রাজশাহী সব বিতর্ক উড়িয়ে দিয়ে প্লে-অফে খেলার দৌড়ে পা দিয়েছে। যেখানে খুলনা-চিটাগং কোনভাবেই পদস্খলিত হলেই সেরা চারের টিকিট কাটবে তাসকিনের দল।
সংকট আর নামের বিচারে পিছিয়ে পড়া এমন দলের সাফল্যকে শক্তি বানাতে পারেন ‘পাশের বাসার আন্টি’ চরিত্র। রাজশাহীর সাফল্যকে পুঁজি বানিয়ে করতে পারেন বিপিএলের প্রতিটি দলের সমালোচনা। টেবিল টপার রংপুর থেকে শুরু করে তলানিতে থাকা সিলেট স্ট্রাইকার্স, সব দলই রাজশাহীর পরিস্থিতি বিবেচনায় সমালোচনা শোনার যোগ্য।
শুরুটা রংপুরকে দিয়ে করা যাক। চলতি বিপিএলে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে রংপুর রাইডার্স। গ্লোবাল সুপার লিগের শেষ তিন ম্যাচ থেকে অজেয় হয়ে উঠেছিল দলটি। বিপিএলেও টানা ৮ ম্যাচে সোহানদের হারাতে পারেনি কোনো দল। এর মধ্যে বাকি সব দলের সাথে অন্তত ১টি ম্যাচ খেললেও বাকি ছিল রাজশাহী। কিন্তু পয়েন্ট টেবিলে পিছিয়ে পড়া সেই দুর্বল রাজশাহীই রংপুরের জয়ের রথ থামিয়েছে। তাতে উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করা দলটিকে হারিয়েছে টানা দুই বার। ফলে পরীক্ষায় ‘ফুল মার্ক’ না পাওয়ায় রংপুরের ম্যানেজমেন্টের কানভারী করতে পারেন পাশের বাসার আন্টি। লাইনটা হতে পারে এমন, ‘টাকা নাই, ভালো খেলোয়াড় নাই, কম্বিনেশনের ঠিক নাই; তবুও এই দলের সাথে কীভাবে টানা দুটো ম্যাচ হারে রংপুর? অথচ এই দলকে তো অমুক তমুক বড় ব্যবধানে হারিয়েছে।’
পয়েন্ট তালিকায় রংপুরের পরেই অবস্থান করছে গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশাল। বর্তমানে রংপুর, বরিশালের পয়েন্ট সমান হলেও রান রেট বিবেচনায় পিছিয়ে পড়েছে তামিমের দল। চলতি আসরে এখন পর্যন্ত দশ ম্যাচ খেলা বরিশালের জয় ৮টি, হার ২টি। পরাজয়ের দুটোই আবার রংপুরের বিপক্ষে। নাম ও মানের বিচারে রংপুরের সমান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত বরিশাল দুইবারের মুখোমুখি দেখায় ফরচুনের দেখা পায়নি। এমনকি দুই দলের সবশেষ দেখায় শেষ ওভারে ৩০ রান নিয়ে জিতেছিল রংপুর। আবার সেই রংপুরকে টানা দুই ম্যাচ হারালো নানান সীমাবদ্ধতায় পড়া রাজশাহী। তাতে ‘আন্টি’ চরিত্রের মতো প্রশ্ন তোলা যায়, কেন রংপুরের কাছে এভাবে আত্মসমর্পণ করলো বরিশাল?
একই কথা অবশ্য বাকি দলগুলোর জন্যেও প্রযোজ্য। প্রতিযোগিতার সেই ভাঙাচোরা দলটি রংপুরকে দুই ম্যাচেই হারাতে পারলে বাকিদের সমস্যা কোথায়! বিশেষ করে বড় বাজেটের দল ঢাকা ক্যাপিটালস খেলোয়াড়দের কাছে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জবাবদিহি চাইতে পারে। পারিশ্রমিক ইস্যুতে বিতর্কিত বিপিএলের একাদশ আসরে শাকিব খানের দল সবচেয়ে বেশি টাকা প্রদান করেছিল। সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি নিয়ে এখন পর্যন্ত খেলোয়াড়দের কোনো আক্ষেপ শোনা যায়নি। অথচ এই দলটাই আসরের প্রথম ৬টি ম্যাচ টানা হেরেছিল। ঘরের মাঠে রংপুরকে পেয়েও হারাতে পারেনি বন্দর নগরীর দল চট্টগ্রাম। এমনকি জেতা ম্যাচটাও রংপুরের কাছে বিলিয়ে দিয়েছিল প্লে-অফের স্বপ্ন দেখা খুলনা টাইগার্স। আর পরীক্ষায় বারবার ফেইল করে সমালোচনার কোনো মুখই রাখেনি সিলেট স্ট্রাইকার্স।
রংপুরের টানা জয় আর সিলেটের ভরাডুবির মাঝে বাকিদের টুকটাক ব্যর্থতা নিয়ে অবশ্য এত আলোচনা উঠতো না। কিন্তু ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চার হয়েও পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন কিংবা দরিদ্র ছেলেটার তাক লাগানো ফলাফলে পাশের বাসার আন্টির মতো বিপিএলের বাকি দলগুলোকে ব্যর্থতার সমালোচনায় ডুবিয়েছে দুর্বার রাজশাহী। যার ঝড়ে সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত হয়েছে রংপুর রাইডার্স। তাসকিনদের বিপক্ষে প্রথম হারের পর বিষয়টাকে ‘এলার্মিং’ হিসেবে দেখেছিলেন রাইডার্সের অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান। পরের ম্যাচে পরাজয় বরণ করে রংপুরের কোচ আশরাফুল বলেছিলেন পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। ঘাটতিটা অবশ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে এখন পর্যন্ত কাঙিক্ষত পেমেন্ট না পাওয়া দুর্বার রাজশাহী। তাতেই পাশের বাসার আন্টির মতো বাকিদের জন্য সমালোচনার ময়দান উন্মুক্ত করে দিল তাসকিনদের দল।
এমআই